৭০ শতাংশ নারীই পুরুষকে সহযোগী মনে করেন না, মনে করেন প্রতিপক্ষ - বলছে গবেষণা

 ৭০ শতাংশ নারীই পুরুষকে সহযোগী মনে করেন না, মনে করেন প্রতিপক্ষ - বলছে গবেষণা



নারীরা পুরুষকে সহযোগী না মনে করে প্রতিপক্ষ – আধুনিক গবেষণার আলোকে

বর্তমান যুগে নারী-পুরুষ সম্পর্কের পরিবর্তন লক্ষণীয়। বিশেষ করে সাম্প্রতিক গবেষণায় উঠে এসেছে যে, প্রায় ৭০ শতাংশ নারী পুরুষদের সহযোগী হিসেবে না দেখে প্রতিপক্ষ হিসেবে অভিহিত করেন। এই দৃষ্টিভঙ্গির পেছনে রয়েছে নানা সামাজিক, মনস্তাত্ত্বিক এবং সাংস্কৃতিক কারণ। ২০২২ সালের পর প্রকাশিত একাধিক গবেষণায় এ বিষয়ে গভীর বিশ্লেষণ করা হয়েছে। বিশেষ করে ড. জয়স বেনেনসন ও তাঁর সহকর্মীরা Journal of Social Psychology-এ প্রকাশিত এক গবেষণায় জানান, নারীরা পুরুষদের প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখতে বেশি ঝোঁক রাখেন, যা তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক ও সামাজিক স্থিতিশীলতায় প্রভাব ফেলছে। এই প্রবন্ধে আমরা আধুনিক গবেষণার আলোকে এ বিষয়ের কারণ, প্রভাব এবং সম্ভাব্য সমাধান নিয়ে আলোচনা করব।


 

গবেষণায় উঠে এসেছে যে, নারীদের মধ্যে পুরুষদের প্রতি প্রতিযোগিতামূলক মনোভাবের মূল উৎস হল সামাজিক কাঠামো ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষিত। ঐতিহাসিকভাবে সমাজে পুরুষ-নারীর ক্ষমতার ভারসাম্য ছিলো অসম, যেখানে পুরুষদের প্রাধান্য ছিলো। কিন্তু আধুনিককালে নারীর শিক্ষাগত ও অর্থনৈতিক অবস্থান শক্তিশালী হওয়ার ফলে ক্ষমতার সমবণ্টন নতুনভাবে সাজানো হচ্ছে। এই পরিবর্তনের মাঝে নারীরা পুরুষদেরকে একধরনের ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ বা ‘প্রতিপক্ষ’ হিসেবে দেখতে শুরু করেছেন।


ড. বেনেনসনের গবেষণা বলছে, নারীরা পুরুষদের সঙ্গে সহযোগিতার বদলে প্রায়ই প্রতিযোগিতার মনোভাব নিয়ে থাকেন, যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গোপনীয় ও সূক্ষ্ম কৌশল হিসেবে প্রকাশ পায়, যেমন গসিপ, মানসিক প্রতিহিংসা, অথবা কর্মক্ষেত্রে একে অপরের বিরুদ্ধে চক্রান্ত। এর কারণ হলো, নারীরা প্রায়শই নিরাপত্তা ও ক্ষমতার জন্য উদ্বিগ্ন থাকেন, তাই তারা পুরুষদেরকে নিজের স্বার্থের জন্য ‘প্রতিপক্ষ’ হিসেবেই দেখেন।


 

মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়, নারীর মস্তিষ্কে সংবেদনশীলতা ও অনুভূতির মাত্রা পুরুষদের থেকে বেশি, যা সামাজিক প্রতিযোগিতায় তাদেরকে সতর্ক ও রক্ষামূলক করে তোলে। এই মনস্তাত্ত্বিক পার্থক্য নারীদের পুরুষদের প্রতি অবিশ্বাসী বা প্রতিদ্বন্দ্বী মনোভাব গড়ে তুলতে সাহায্য করে। ডঃ এলিসা মার্টিনের ২০২৩ সালের গবেষণা অনুযায়ী, নারীরা যখন মনে করেন যে পুরুষরা তাদের সুযোগ-সুবিধা বা ক্ষমতা হরণ করছে, তখন তারা প্রতিরক্ষামূলক মনোভাব গ্রহণ করেন যা সহানুভূতি থেকে বিরত থাকে।


 

আজকের জটিল ও গতিশীল সমাজে নারীর ভূমিকা অনেকাংশে পরিবর্তিত হয়েছে। নারীরা শুধু গৃহিণী নয়, কর্মজীবী, শিক্ষাবিদ, উদ্যোক্তা ও নেতা হিসেবে সামনে এসেছেন। এই পরিবর্তন পুরুষদের ঐতিহ্যগত ক্ষমতার সঙ্গে সংঘর্ষ সৃষ্টি করেছে। ফলে নারীরা পুরুষদেরকে এক ধরণের ‘প্রতিপক্ষ’ বা ‘বিরোধী’ ভাবতে বাধ্য হচ্ছেন।


অন্যদিকে, পুরুষরাও নিজেদের নিরাপত্তাহীনতা অনুভব করছেন এবং তাদের আধিপত্য হারানোর ভয় থেকে নারীদের সঙ্গে দ্বন্দ্বমূলক সম্পর্ক বজায় রাখছেন। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, এই দ্বন্দ্ব শুধুমাত্র ব্যক্তিগত নয়, বরং পেশাগত ও সামাজিক স্তরেও বিস্তার লাভ করেছে। ফলে নারীর দৃষ্টিভঙ্গি ‘সহযোগী’ থেকে ‘প্রতিপক্ষ’ হয়ে দাঁড়িয়েছে।


 

ড. জয়স বেনেনসন ও তাঁর সহকর্মীদের গবেষণা (২০২৩) Journal of Social Psychology-এ প্রকাশিত হয়েছে। তারা বিভিন্ন দেশের ৫০০০ নারী ও পুরুষের ওপর জরিপ পরিচালনা করেন এবং বিশ্লেষণ করেন যে, ৭০ শতাংশ নারী পুরুষদের সহযোগী না দেখে প্রতিপক্ষ মনে করেন। একই সঙ্গে ড. এলিসা মার্টিনের মনোবিজ্ঞান ভিত্তিক গবেষণা (২০২৪) সামাজিক প্রতিযোগিতার মেকানিজম ও নারীদের মনস্তাত্ত্বিক অবস্থান ব্যাখ্যা করে।


এই গবেষণা গুলো প্রমাণ করে যে, নারীদের পুরুষদের ওপর অবিশ্বাস ও প্রতিদ্বন্দ্বী মনোভাব সমাজের নানান স্তরে প্রভাব ফেলে এবং এটি পারস্পরিক সম্পর্কের স্থায়িত্বের জন্য হুমকি স্বরূপ।


 

যখন নারীরা পুরুষদের সহযোগী না দেখে প্রতিপক্ষ মনে করেন, তখন পারিবারিক জীবনে দ্বন্দ্ব ও বিভ্রান্তি বৃদ্ধি পায়। দম্পতির মধ্যে সম্পর্কের অবনতি, কর্মক্ষেত্রে যৌথ উদ্যোগের ব্যর্থতা, এবং সামাজিক সংঘর্ষের মাত্রা বেড়ে যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, এ ধরনের মনোভাব থাকায় নারীদের মানসিক চাপ বেড়ে যায় এবং পুরুষদেরও আত্মবিশ্বাস কমে যায়। ফলে একে অপরের প্রতি অসন্তোষ ও সন্দেহ গড়ে ওঠে।


 

গবেষকেরা মনে করেন, নারীদের পুরুষদের সঙ্গে সহযোগী মনোভাব গড়ে তুলতে হলে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা জরুরি। শিক্ষাব্যবস্থায় লিঙ্গ সমতা ও পারস্পরিক সম্মানের বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া, পরিবার ও কর্মক্ষেত্রে সমঝোতা ও সংলাপ বাড়ানো জরুরি। তাছাড়া, মনস্তাত্ত্বিক সহায়তা ও কাউন্সেলিং-এর মাধ্যমে নারীর আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি এবং পুরুষদের সঙ্গে ইতিবাচক সম্পর্ক গড়ে তোলা যেতে পারে।


 

বর্তমান গবেষণাগুলো স্পষ্ট করছে যে, সমাজের নানা পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে নারীরা পুরুষদের সহযোগী হিসেবে না দেখে প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখতে বেশি ঝুঁকছেন। এটি শুধুমাত্র একটি ব্যক্তিগত মনোভাব নয়, বরং বৃহত্তর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের অংশ। তবে সচেতন প্রচেষ্টা ও শিক্ষা মাধ্যমে এই বিভাজন কাটিয়ে উঠা সম্ভব, যা সমৃদ্ধ ও সুস্থ সমাজ গঠনে সহায়ক হবে।

Countdown Timer
00:01

Comments