আত্মীয়ের মধ্যে বিবাহে যেসব বংশগত রোগের ঝুঁকি
বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশেই আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে বিবাহ প্রচলিত একটি প্রথা। এই প্রথার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব থাকলেও এতে রয়েছে কিছু গুরুতর স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি। যার মধ্যে অতি পরিচিত দুটি রোগ হলো থ্যালাসেমিয়া ও হিমোফিলিয়া। এ ছাড়াও জন্মের পর শিশু মৃত্যু ও বংশানুক্রমিক নানা রোগের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়।
নিকট আত্মীয়র মধ্যে বিয়ের ঝুঁকি এবং এই ঝুঁকি থেকে সুরক্ষায় কিছু কার্যকরী পদক্ষেপ নিয়ে তুলে ধরা হলো—
জেনেটিক ঝুঁকি
আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে বিবাহের সব চেয়ে বড় ঝুঁকি হলো জেনেটিক। এর প্রধান কারণ হলো, আত্মীয়দের মধ্যে জেনেটিক উপাদান একই হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে, যা জেনেটিক রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। এ কারণে সন্তানদের জেনেটিক এবং বিভিন্ন জন্মগত ত্রুটি হওয়ার ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়।
অটোজোমাল রিসেসিভ রোগ
অটোসোমাল রিসেসিভ রোগ হলো এমন ভয়াবহ রোগ, যা দুটি রিসেসিভ জিনের সংমিশ্রণে ঘটে। প্রতিটি ব্যক্তির দুটি করে জিন থাকে, একটি মা থেকে এবং একটি বাবা থেকে আসে। যখন উভয় পিতা-মাতা একটি করে রিসেসিভ জিন বহন করেন এবং এটি সন্তানের মধ্যে একত্রিত হয়, তখন সন্তানের মধ্যে সেই রোগটি দেখা দেয়। যেমন—সিস্টিক ফাইব্রোসিস, থ্যালাসেমিয়া, সিকল সেল অ্যানিমিয়া।
জন্মগত ত্রুটি
আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে বিবাহের ফলে জন্মগত ত্রুটি এবং বিভিন্ন জেনেটিক সিনড্রোম, যেমন: ক্লেফট লিপ/প্যালেট, ডাউন সিনড্রোম, কনজেনিটাল হার্ট ডিজিজের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়।
শিশু মৃত্যুহার
আত্মীয়ে মধ্যে বিবাহের ফলে জন্মগত ত্রুটি এবং শিশু মৃত্যুহার বৃদ্ধি পায়। গবেষণায় দেখা গেছে, আত্মীয় বিবাহের ফলে শিশু মৃত্যুহার ৩ থেকে ৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেতে পারে।
অসুস্থতার হার বৃদ্ধি
আত্মীয়-স্বজনের সাথে বিবাহের কারণে শিশুদের মধ্যে অসুস্থতার হার বৃদ্ধির পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা, যেমন—মানসিক উন্নয়নে বিলম্ব, শারীরিক বৃদ্ধিতে সমস্যার ঝুঁকি থাকে।
মানসিক এবং শারীরিক স্বাস্থ্য
আত্মীয়ে মধ্যে বিবাহের ফলে শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যে সমস্যা, যেমন—অটিজম, বুদ্ধিমত্তার কমতি এবং শিখন সমস্যা দেখা দিতে পারে।
বংশানুক্রমিক রোগ
আত্মীয়ে মধ্যে বিবাহের কারণে বংশানুক্রমিক রোগের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়, যা পরবর্তী প্রজন্মেও অব্যাহত থাকতে পারে।
পরিবারে স্বাস্থ্য সমস্যা তৈরি
আত্মীয়ে মধ্যে বিবাহের ফলে একই পরিবারের বিভিন্ন সদস্য একই ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগতে পারে, যা পুরো পরিবারের স্বাস্থ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
এ ছাড়াও নিকটাত্মীয়ের মধ্যে বিয়ের কারণে সন্তানের যেসব ঝুঁকি বাড়ে তা হলো—
গর্ভপাত ও মৃত সন্তান প্রসব, শারীরিক ত্রুটিসংবলিত শিশুর জন্ম স্বাভাবিকের চেয়ে ৫ গুণ বেশি, প্রথম বছর বয়সে শিশুর অস্বাভাবিক মৃত্যু, হঠাৎ অজানা কারণে শিশুমৃত্যু, যথাযথভাবে শিশু বৃদ্ধি না হওয়া, শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তি ও বুদ্ধি প্রতিবন্ধিতা, মৃগী রোগ, অজানা রোগ এবং নানা রকমের রক্তরোগ যেমন সিকেল সেল ডিজিজ ও বিটা থ্যালাসেমিয়া।
প্রতিরোধ ও সচেতনতা
নিকট আত্মীয়র বিয়েতে জন্মগত ত্রুটি এবং জেনেটিক রোগের ঝুঁকি কমাতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। যেমন—
জেনেটিক কাউন্সেলিং
সমাজে নিকট আত্মীয়ের মধ্যে বিয়ের ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষে বিয়ের পূর্বে এর ক্ষতিকর ঝুঁকিগুলো বিস্তারিতভাবে জানানো জরুরি।
প্রি-ম্যারিটাল মেডিকেল চেকআপ
বিবাহের আগে একটি মেডিকেল চেকআপ এবং জেনেটিক স্ক্রিনিং বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে, যা সম্ভাব্য ঝুঁকি শনাক্ত করতে সাহায্য করবে। এছাড়াও এটি গর্ভধারণের পূর্বেই জেনেটিক স্ক্রিনিং ও টেস্টিং এর মাধ্যমে থ্যালাসেমিয়া, সিস্টিক ফাইব্রোসিস, সিকল সেল অ্যানিমিয়া ইত্যাদি রোগ সম্পর্কে জানা যেতে পারে।
সরকারের ভূমিকা ও নীতি
সরকার ও স্বাস্থ্য সংস্থাগুলো জেনেটিক কাউন্সেলিং এবং স্ক্রিনিং সেবা প্রদান করতে পারে। এ ছাড়া আত্মীয় বিবাহের ঝুঁকি সম্পর্কে জনসাধারণকে সচেতন করার জন্য প্রচারণা চালানো উচিত। এ ছাড়াও সরকার একটি জেনেটিক ডাটাবেস বা রেজিস্ট্রি তৈরি করা যেতে পারে, যেখানে পরিবারগুলির জেনেটিক ইতিহাস সংরক্ষিত থাকবে। এটি জেনেটিক ঝুঁকি শনাক্ত করতে সাহায্য করবে।
বংশগত ইতিহাস জানা
বিয়ের পূর্বে পরিবারের জেনেটিক ইতিহাস সম্পর্কে অবগত থাকা এবং সেই অনুযায়ী সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া।
স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা
স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা, যেমন—স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত ব্যায়াম এবং স্বাস্থ্য পরীক্ষা জেনেটিক ঝুঁকি কমাতে সহায়ক হতে পারে।
সচেতনতামূলক কার্যক্রম
সরকার এবং বেসরকারি সংস্থাগুলি যৌথভাবে জেনেটিক ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতনতামূলক কার্যক্রম বাড়াতে পারে। এরই অংশ হিসেবে টেলিভিশন, রেডিও, সোশ্যাল মিডিয়া এবং অন্যান্য গণমাধ্যমের এই ঝুঁকি নিয়ে আলাচনা, সামাজিক এবং ধর্মীয় নেতাদের মাধ্যমে এ সম্পর্কে জানানো। এ ছাড়াও বিবাহের আগে এবং গর্ভধারণের আগে একজন চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে।
দীর্ঘমেয়াদি গবেষণা
দীর্ঘমেয়াদি গবেষণা এবং পর্যবেক্ষণমূলক অধ্যয়ন পরিচালনা করে জেনেটিক ঝুঁকি এবং প্রতিরোধের কার্যকর পদ্ধতি খুঁজে বের করা।
যেসব আত্মীয়ের মধ্যে বিবাহে বংশগত রোগের ঝুঁকি
প্রথম পর্যায়ের বা ফার্স্ট ডিগ্রি রিলেটিভ মানে আপন চাচাতো, মামাতো, খালাতো, ফুফাতো ভাইবোনের মধ্যে বিয়ে। আর দ্বিতীয় বা সেকেন্ড ডিগ্রি রিলেটিভ মানে বাবা বা মায়ের চাচাতো, মামাতো, খালাতো বা ফুফাতো ভাইবোনের সন্তানদের মধ্যে বিয়ে। এই দুই ধরনের কাজিন ম্যারেজের কারণে জন্ম নেওয়া সন্তানের মধ্যে নানা বংশগত রোগের ঝুঁকি বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়। বিশেষত জিনবাহিত বংশধারার রোগগুলোর প্রকোপ এতে বাড়ে। অসুস্থ জিনগুলোর কার্বন কপি যখন মা-বাবা দুই বাহক থেকে সন্তানে বাহিত হয়, তখন তা তীব্র আকারে প্রকাশ পায়।
উপসংহার
আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে বিবাহের কারণে জন্মগত ত্রুটি, জেনেটিক রোগ এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যাই দেখা দেয় না, বরং এগুলোর কারণে প্রভাবিত ব্যক্তিদের জীবনকে দুঃসহ করে তোলো এবং পরিবারগুলোর জন্য প্রচুর আর্থিক ও মানসিক চাপ সৃষ্টি করে। তাই ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে সবাইকে ভালো থাকার, সুস্থ থাকার উপায় খুঁজতে হবে।
এমইউ/
Comments
Post a Comment